১৬৩ বছর পুরনো ব্রিটিশ আমলের দণ্ডবিধিতে বড় পরিবর্তন আনছে ভারত। এরই লক্ষ্যে গেল সপ্তাহে সংসদে তিনটি নতুন বিল উত্থাপন করেছে দেশটির ক্ষমতাসীন সরকার।
ভারতীয় সাক্ষ্য আইন বা ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট— এই তিন আইনের পরিবর্তে নতুন তিনটি আইন আনা হবে।
ফৌজদারি কার্যবিধির স্থলাভিষিক্ত হবে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা এবং ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের স্থলাভিষিক্ত হবে ভারতীয় সাক্ষ্য।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশটির বিচার ব্যবস্থাকে ঘিরে সংসদে উত্থাপিত নতুন বিলে গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু পরিবর্তন রয়েছে।
নতুন বিলে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, গণপিটুনি এবং সংঘটিত অপরাধের মতো অপরাধগুলোকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।
অপরাধ দেশের যে স্থানেই হোক না কেন, যেকোনো থানায় সেই অভিযোগ নথিভুক্ত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
এছাড়াও নতুন আইনে তদন্ত চলাকালীন অনুসন্ধান ও অভিযানের ভিডিও রেকর্ডিংয়ের এবং বিভিন্ন ইলেকট্রনিক প্রমাণ ও ফরেনসিকের ব্যবহার বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে।
এছাড়াও অভিযুক্তের অনুপস্থিতিতে ভিডিও ট্রায়েলেরও মাধ্যমে দ্রুত বিচারের পক্ষেও বলা হয়েছে।
তবে এই পরিবর্তিত আইনগুলো কীভাবে কাজ করবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সন্দিহান।
দিল্লির ন্যাশনাল ল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের অধ্যাপক অনুপ সুরেন্দ্রনাথ বলেছেন,
‘বিলে উত্থাপিত নতুন অপরাধগুলো যেমন: সার্বভৌমত্ব বিপন্ন, সংঘটিত অপরাধ, গণপিটুনি, সন্ত্রাসবাদ,
বিয়ের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণ- এসবের খসড়া এতই বেশি অস্পষ্ট যে এটি পুলিশকে অযৌক্তিকভাবে গ্রেফতারের ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে।
এই অস্পষ্ট বিধানগুলো সাংবিধানিকভাবে অগ্রহণযোগ্য উপায়ে পুলিশের ক্ষমতা প্রয়োগকে স্থায়ী করবে।’
কয়েক দশক ধরেই ছাত্র, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী এবং কর্তৃত্বের সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হচ্ছে ভারতের ঔপনিবেশিক যুগের কঠোর রাষ্ট্রদ্রোহ আইন।
তবে এই আইন পুরোপুরি বাতিল হয়নি বলে মন্তব্য করছেন বিশেজ্ঞরা।
নতুন বিলটিতে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন এসেছে অন্য নামে, যা ভারতের সার্বভৌমত্ব, একতা ও অখণ্ডতাকে বিপন্ন করার জন্য শাস্তি দেবে।
দিল্লিভিত্তিক থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক, বিধি সেন্টার ফর লিগ্যাল পলিসির সিনিয়র কর্মকর্তা নাভিদ মেহমুদ আহমেদ বলেন,
‘এটি (নতুন আইন) রাষ্ট্রদ্রোহের একটি সম্প্রসারিত সংজ্ঞা। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা পুরোপুরি বাতিল হওয়া উচিত ছিল।
এটিকে ধরে রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এটি আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছে।’
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, প্রস্তাবিত বিলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক উপেক্ষিত হয়েছে।
ভারতে নারীদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও ‘বৈবাহিক ধর্ষণকে’ অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়নি।
এছাড়াও রাষ্ট্রদ্রোহ ও অশ্লীলতার মতো আইনগুলো পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন।
এ বিষয়ে বিশ্লেষক নাভেদ মাহমুদ আহমেদ বলেছেন, ‘বিলগুলোতে ধর্ম এবং ধর্মনিন্দা সম্পর্কিত অপরাধগুলোকেও পুনর্বিবেচনা করা উচিত ছিল।
এসব অপরাধ এখনও অনেক বেশি অস্পষ্ট রয়েছে। বেশ কিছু প্রস্তাব এখনো অনেক অস্পষ্ট বলে মনে হচ্ছে।’
একটি বিধান তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘জাতিগত বিবেচনার ভিত্তিতে খুনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া,
গণপিটুনির জন্য সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক ব্যক্তির ন্যূনতম সাত বছরের কারাদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা এমনকি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।
হত্যার জন্য ৫০ জনের একটি দলকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কথা কল্পনাও করা যায় না।’
অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথের মতে, ‘নতুন এই বিলে বহু প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিলগুলোতে প্রস্তাব করা হয়েছে, প্রতিটি অপরাধের অবশ্যই ফরেনসিক তদন্ত করা উচিত।
কিন্তু ভারতের ফরেনসিক সিস্টেম কি এর জন্য প্রস্তুত? সবাই জানে এটা সম্ভব না।’
বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন বিলগুলো ১৬০ বছরের পুরনো ভারতীয় দণ্ডবিধির ৮০ শতাংশেরও বেশি ধরে রেখেছে।
এই সংশোধন কোনো সংশোধন নয়। উত্থাপিত বিলে বেশিরভাগই নতুন নামে একই বিধান রেখেছে বলেও মনে করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আইন প্রত্যাহার করা ও অনুসরণ করার মতো বিশাল প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার পরিবর্তে, ভারত কেবল বিদ্যমান আইনগুলো সংশোধন করতে পারত।
সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং ভুটানের মতো দেশগুলো এখনও ঔপনিবেশিক দণ্ডবিধি ব্যবহার করছে।
সিঙ্গাপুর সম্প্রতি তাদের দণ্ডবিধি সংশোধন করেছে। ভারতও ২০১৩ সালে যৌন সহিংসতার বিষয়ে আইন পরিবর্তন ও সংস্কার করেছে।
ফৌজদারি আইন কী ও কবে প্রণয়ণ করা হয়?
অপরাধ দমন ও অপরাধ উদ্ঘাটন, অপরাধীদের বিচার এবং তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে অপরাধীদের প্রদত্ত শাস্তি বা দণ্ডের পরিমাণ সম্পর্কিত আইনবিধানই ফৌজদারি আইন।
একটি ধারা ছিল মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অর্থাৎ মুসলিম আইনের আওতাভুক্ত। অপরদিকে ছিল হিন্দু প্রথা ও রীতিনীতি।
ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ফৌজদারি আইন প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত করতে প্রায় তিন দশক সময় লেগে যায়।
আইনের এই সারগ্রন্থ রচনা ছিল দুটি আইন কমিশনের শ্রমসাধ্য প্রচেষ্টার ফল।
টমাস বেবিংটন ম্যাকলের নেতৃত্বে প্রথম কমিশন গঠিত হয় ১৮৩৭ সালে।
দ্বিতীয় কমিশন ১৮৫৩ সালে ইংল্যান্ডে গঠন করা হয়।
এ সময়ের অন্যতম বিতর্কিত বিষয় ছিল ভারতে অবস্থানকারী ইউরোপীয় এবং ভারতীয়দের জন্য স্বতন্ত্র বিধিব্যবস্থার প্রবর্তন।
ইউরোপীয়দের পৃথক আদালত এবং স্বতন্ত্র আইনের অধীনে আনা হয়েছিল।
একই আইনের অধীনে নিরাপত্তা বিধানের সমতা এবং আইনের শাসনের নীতির ওপর ভিত্তিশীল অভিন্ন বিচার ব্যবস্থার প্রবর্তন সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠে।
এক্ষেত্রেই ম্যাকলে হস্তক্ষেপ করেন। তিনি আইন প্রণয়নের ভিত্তির নীতিমালা নির্ধারণ করে দেন।
এটিই ছিল পথনির্দেশক নীতি যার মাধ্যমে বিচার প্রশাসনের দ্বৈত ব্যবস্থার বিলোপ সাধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
এ প্রক্রিয়ার ফলেই প্রণীত হয় ভারতীয় পেনাল কোড (১৮৬০ সালের ৪৫ নম্বর আইন) এবং ফৌজদারি কার্যবিধি (১৮৬১ সালের ২৫ নম্বর আইন)।
১৯৪৭ সালের পর ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের নাম পরিবর্তন করে পাকিস্তান পেনাল কোড করা হয়।
অনুরূপভাবে ১৯৭১ সালের পর পাকিস্তান পেনাল কোড বাংলাদেশ পেনাল কোড নামে পরিচিত হয়।
তবে বাংলাদেশে এখনো ফৌজদারি দণ্ডবিধির কোনো সংস্কার বা পরিবর্তন ঘটেনি।
সম্প্রতি পাকিস্তানে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে লাহোরের হাইকোর্ট।
কিন্তু এখন পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের কোনো চূড়ান্ত রায় হয়নি।
যার ফলে পাকিস্তানেও এখনো ব্রিটিশ আমলের দণ্ডবিধি বলবৎ রয়েছে।