দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আগস্ট মাস সবে শুরু হয়েছে, বছর শেষ হতে এখনও প্রায় পাঁচ মাস বাকি।
এরমধ্যে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর পরিসংখ্যানে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে চলতি বছর।
গত ২৪ ঘণ্টায় ১০ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ বছর মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ২৮৩ জনে।
এর আগে ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে এক বছরে সর্বোচ্চ ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে বছরের শুরুতেই বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা ছিল। তারপরও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দেখা গেছে গা ছাড়া ভাব।
এতে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে এডিস মশাবাহিত এই রোগ।
বছরের অর্ধেকেই মৃত্যুতে রেকর্ড
এরপর ২০০১ সালে ৪৪ জন, ২০০২ সালে ৫৮ জন, ২০০৩ সালে ১০ জন, ২০০৪ সালে ১৩ জন, ২০০৫ সালে ৪ জন এবং ২০০৬ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১১ জনের মৃত্যু হয়।
যদিও স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যানে ২০০৭ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যুর খবর নেই।
এরপর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২০১১ সালে ৬ জন, ২০১২ সালে একজন এবং ২০১৩ সালে দু’জন মারা যায়।
আর ২০১৪ সালে কেউ মারা গেছে কি না তা জানাতে পারেনি অধিদফতর।
২০১৫ সাল থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ক্রমেই বাড়তে থাকে মৃত্যুর সংখ্যা।
ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৬ জনের মৃত্যুর খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর।
পরের বছর ২০১৬ সালে ১৪ জন, ২০১৭ সালে ৮ জন, ২০১৮ সালে ২৬ জন, ২০১৯ সালে ১৭৯ জন, ২০২০ সালে ৭ জন, ২০২১ সালে ১০৫ জন এবং সবশেষ ২০২২ সালে ২৮১ জনের মারা যান ডেঙ্গুতে।
এবার ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে না পারলেও ২০১৯ ও ২০২২ সালের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে।
প্রকোপ যে হারে বাড়ছে তাতে বছরের বাকি পাঁচ মাসে মৃত্যুর মতো হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যাও যে বিগত সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে তা ধারণা করা যায়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে,
এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯ হাজার ৭১৬ জনে।
এর আগে ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৬১ হাজার রোগী,
আর ২০১৯ সালে রেকর্ড ১ লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।
২০২৩ সালের জুলাই ভয়ঙ্কর
এবার আসা যাক চলতি বছরের মাসভিত্তিক হিসাবে।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চলতি মাসের প্রথম তিন দিনে ৭ হাজার ৮৮৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এ সময় মৃত্যু হয়েছে ৩২ জনের। অর্থাৎ দিনে ১০ জনের বেশি রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
আর এখন পর্যন্ত বছরের সবচেয়ে ভয়াবহ মাস হিসেবে দেখা হচ্ছে সদ্য বিদায় নেয়া জুলাইকে।
ওই মাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে।
আর আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৪৩ হাজার। যা কিনা জুন মাসের তুলনায় সাতগুণ বেশি।
এ বছরের জুন মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৫ হাজার ৯৫৬ জন, মৃত্যু হয়েছিল ৩৪ জনের।
মে মাসে এক হাজার ৩৬ জনের হাসপাতালে ভর্তির বিপরীতে মৃত্যু হয়েছিল ২ জনের। এপ্রিলে আক্রান্ত ১৪৩ জন, মৃত্যু ২ জন।
মার্চ মাসে ১১১ জনের আক্রান্তের খবর দিলেও কোন মৃত্যুর হিসেব স্বাস্থ্য অধিদফতর তাদের পরিসংখ্যানে দেখায়নি।
এর আগে ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, মৃত্যু হয়েছিল ৩ জনের।
আর বছরের প্রথম মাসে ৫৬৬ জনের আক্রান্তের বিপরীতে ৬ জনের মৃত্যুর খরব দিয়েছে অধিদফতর।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, দ্রুতই ভ্যাকসিন ট্রায়াল শুরুর কথা ভাবা হচ্ছে।
এ বিষয়ে যাথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বলেন, ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশনের টেকনিক্যাল মিটিংয়ে আমাদের ভ্যাকসিন বিষয়ে কথা হয়েছে।
এ বিষয়ে আরও একটি মিটিং আছে। আমরা চাইছি দ্রুততম সময়ে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল শুরু করতে।
টালমাটাল হাসপাতাল
রোগীর চাপে টালমাটাল দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলো।
রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে,
তীব্র জ্বর আর গা ব্যথা নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন রোগীরা।
রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীদের।
শুধু ঢাকা মহানগরীতেই সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে এখন ৫৩টি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে।
সবচেয়ে বেশি রোগী রয়েছে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
এই হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, খেতে যাওয়ার সময়ও পাচ্ছেন না তারা।
কিছুক্ষণ পরপর রোগী চলে আসে। একসঙ্গে ৫-৭ জন রোগী চলে আসে।
বিছানা ফাঁকা নেই, তাই ডেঙ্গুতে সেবা নিতে আসা রোগীদের শেষ ভরসা হাসপাতালের মেঝে।
এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতাল,
বেসরকারি হলি ফ্যামিলি, রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে অনেক রোগী ভর্তি রয়েছেন।
বড় হাসপাতালগুলোয় জায়গা না হওয়ায় অনেক রোগী মেঝেতে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।
শহর ছেড়ে গ্রামে ডেঙ্গু, সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আট জেলা
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলাতেই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।
বর্তমানে ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের আট জেলার মোট পাঁচ কোটি ৮৬ লাখ ৮৩ হাজার ৪৪১ মানুষ।
দেশে যে সময়কালকে ডেঙ্গুর মৌসুম বলে ধরা হয়, তার আগেই আক্রান্তের সংখ্যা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
বিশেষ করে ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্তদের বেশির ভাগই ঢাকা শহরের বাসিন্দা।
ঢাকার বাইরে বেশির ভাগ মানুষ প্রথমবারের মতো আক্রান্ত হচ্ছে,
ফলে খুবই খারাপ ধরনের রোগীর সংখ্যা শহরের তুলনায় বা ঢাকার তুলনায় কম।
তবে গত দু-বছরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
তবে ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’ রয়েছে ঢাকা মহানগরীসহ আট জেলা।
মাঠ পর্যায়েও এসব জেলায় এডিস মশার ঘনত্ব ঢাকার মতোই বেশি।
ঢাকার পর যেসব জেলা উচ্চ ঝুঁকিতে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা চট্টগ্রাম ও বরিশালের।
এছাড়া ফরিদপুর, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, গাজীপুর ও চাঁদপুরে পাঁচ কোটি ৮৬ লাখ ৮৩ হাজার ৪৪১ মানুষ বর্তমানে ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
সঠিক হিসাব নেই, সতর্কতায় জোর
স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে যে তথ্য দেয়া হয়,
তাতে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রকৃত তথ্য আসছে না বলে কর্মকর্তারাই স্বীকার করেছেন।
কারণ, যারা আক্রান্ত হয়ে ঘরে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের তথ্য এখানে যুক্ত হয় না।
এমনকি সব বেসরকারি হাসপাতালের তথ্যও এখানে নেই। ফলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত আসলে কত তার সঠিক হিসেব নেই কারো কাছে।
এমন অবস্থায় ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে ব্যক্তিগত সতর্কতা সবচেয়ে বেশি জরুরি বলে মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
তাদের পক্ষ থেকে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে সারা বছরই প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম জারি রাখার কথাও বলা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, বর্তমানে ডেঙ্গুর যে পরিস্থিতি তাতে আমরা সহসা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবো বা ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমানো যাবে, বিষয়টা তেমন না।
বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় ডেঙ্গু রোগীর ব্যবস্থাপনায় বেশি জোর দেয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন,
ডেঙ্গু মোকাবিলায় যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, তা অনেকটা গতানুগতিক। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এটা হয়তো সাময়িক একটা রোগ,
কিছুদিন পরই চলে যাবে। ফলে কার্যকর বা দীর্ঘমেয়াদি কোনও ব্যবস্থা কোথাও নেয়া হচ্ছে না।
ফলে ডেঙ্গু একেবারে জেঁকে বসেছে। যে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার, তা হচ্ছে না।
ফলে ‘আক্রান্তদের মধ্যে ডেঙ্গুর চারটি ধরন বা সেরোটাইপ পাওয়া যাচ্ছে। যারা আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাই বেশি।
২০০০ সালের আগে আমরা দেখেছি, মানুষজন ডেঙ্গুর একটা ধরনে আক্রান্ত হতো।
ফলে তাদের মধ্যে একটা প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে উঠত।
কিন্তু যখন মানুষ চারটি ধরনেই আক্রান্ত হতে শুরু করে, তখন প্রতিরোধক্ষমতা তেমন কাজ করে না।
তখন সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি তিন গুণ বেড়ে যায়।’