আজ ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। বইয়ের পাতায়, লেখার অক্ষরে শব্দগুলো যতটা সহজ করে তরুণ প্রজন্ম পড়ছে, বিষয়টি ততই জটিল। কারণ প্রায় ৪৮ বছর পেরিয়ে গেছে ৭৫-এর কলঙ্কময় সে রাতের। এখনও বাঙালি পারেনি বিভীষিকাময় সে দিনটির কলঙ্ক ঘোচাতে।
ইতিহাসের পাতায় আজকের এই দিনটি ৪৮ বছর পেছনে ফিরে তাকালে বিভীষিকাময় এক দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
এই দিনটি বাঙালিকে এক টানে নামিয়ে নিয়ে আসে বীরের জাতি থেকে খুনির জাতিতে।
খুনিরা চেয়েছিল শুধু জাতির পিতা নয়, তার পুরো পরিবার ও নিকট আত্মীয়কে নিশ্চিহ্ণ করতে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সামরিক অভ্যুত্থানের অভিসন্ধি বাস্তবায়নে পরিকল্পনাকারীদের নেতৃত্বে সেনাদের চারটি দল গঠন করা হয়।
এই জঘন্য ষড়যন্ত্রে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে জাতির পিতা সহ পরিবারের মোট ১৭ সদস্য শহীদ হন।
সর্বমোট ২৬ জনকে খুনিরা নৃশংসভাবে সে রাতে খুন করে।
বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল,
শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান,
কর্ণেল জামিল (বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার), সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক প্রমুখকে খুন করে খ্যান্ত হয়নি খুনিরা।
প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি,
তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী,
পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত,
এক আত্মীয় বেন্টু খান, আবদুল নঈম খান রিন্টু (আওয়ামী লীগ নেতা আমীর হোসেন আমুর খালাতো ভাই) কে খুন করে।
ওই সময় দেশে না থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা।
ভয়ঙ্কর এ হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর ওই সময় খুনিরা প্রকাশ্যে তাদের এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বিভিন্ন বিদেশী সংবাদমাধ্যমে স্বীকার করে।
এ হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই বিচারের আওতায় যেন কোনদিন না আসে তাই দেশে নতুন আইন ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ চালু করা হয়।
শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে অনাক্রম্যতা বা
শাস্তি এড়াবার ব্যবস্থা প্রদানের জন্যই মূলত বাংলাদেশে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন।
বিতর্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ মুজিব হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া রোধ করার জন্য প্রণীত হওয়ায় দীর্ঘ ২০ বছর এ ন্যাক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।
এরপর ৯৬’এ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ দেশ নেতৃত্বের দায়িত্ব পেলে বঙ্গবন্ধুর ২০ খুনিকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন বঙ্গবন্ধুর আবাসিক সহকারী মুহিতুল ইসলাম।
একজন নাগরিক হিসেবে সাধারণ আইনের আওতায় এ মামলা চলে প্রায় দীর্ঘ ১৩ বছর।
বিচারিক আদালত অভিযুক্ত ২০ খুনির মধ্যে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিলে হাইকোর্ট ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে।
অভিযুক্ত সে খুনিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে বিশ্ব দরবারে ৭৫-র সে লজ্জা, সে রক্তের দাম আজও ঘোচাতে পারেনি বাঙালি জাতি।
কারণ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ জনের মধ্যে ৫ খুনি এখনও পলাতক।
৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বিভীষিকাময় রাতের মর্মান্তিক ঘটনার মূল ১২ আসামিরা হলেন-
১। কর্নেল ফারুক রহমান ( ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর)
২। মেজর বজলুল হুদা ( ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর)
৩। মেজর একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ আর্টিলারি ( ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর)
৪। মহিউদ্দিন ল্যান্সার ( ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর)
৫। সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান ( ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর)
৬। আজিজ পাশা ( রায় কার্যকর হওয়ার আগেই ২০০১ সালে জিম্বাবুয়েতে মারা যান )
৭। ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ ( ২০২০ সালের ৬ এপ্রিল রাজধানীর গাবতলী থেকে গ্রেফতারের পর ১১ এপ্রিল মৃত্যুদণ্ড কার্যকর)৮। খন্দকার আব্দুর রশিদ ( সম্ভাব্য অবস্থান অজানা)
৯। নূর চৌধুরী ( কানাডায় পলাতক)
১০। শরিফুল হক ডালিম ( স্পেনে পলাতক)
১১। মোসলেম উদ্দিন ( জার্মানিতে পলাতক)
১২। রাশেদ চৌধুরী ( যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক)
আর কত সময় পার করলে ‘বিভীষিকাময় সে রাত’ আর ‘খুনির জাতি’ কালিমা থেকে মুক্তি পাবে স্বাধীন এ বাংলাদেশ?