গত কয়েক মাস ধরেই রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশ বেলারুশ ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য পোল্যান্ডের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে।
সম্প্রতি রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনার বাহিনী বেলারুশে আসার পর নিরাপত্তা ইস্যুতে সীমান্তে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে।
এরই মধ্যে সীমান্তে সেনা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে পোলিশ কর্তৃপক্ষ।
ইউরোপ তথা সামরিক জোট ন্যাটো রাশিয়ার সামরিক অভিযানের মুখে ইউক্রেনকে নানা রকম সহায়তা দিয়ে আসলেও সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি এড়িয়ে চলেছে পোল্যান্ড।
কিন্তু পোল্যান্ড ও বেলারুশ সীমান্তে চলমান উত্তেজনা সেই ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলছে।
এই উত্তেজনা প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে পূর্ণ সংঘাতের দিকে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
ওয়ারশ অভিযোগ করেছে,
গত মঙ্গলবার (১ আগস্ট) বেলারুশের দুটি হেলিকপ্টার মহড়ার সময় তাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে।
পোল্যান্ডের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা (বেলারুশ) সীমান্তে সামরিক হেলিকপ্টার, অতিরিক্ত বাহিনী ও সামরিক সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে।
আরও বলা হয়,
পুরো বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে তলব করা হয়েছে বেলারুশের চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স তথা রাষ্ট্রদূতকে।
তবে ওয়ারশ’র এই অভিযোগ জোরালোভাবে নাকচ করে দিয়েছে বেলারুশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
বেলারুশের সামরিক বাহিনী বলেছে, সীমান্তে সেনা মোতায়েনের বিষয়টি বৈধ করতেই এই অপচেষ্টা চালাচ্ছে ওয়ারশ।
হঠাৎ কেন উত্তেজনা
ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর পাশাপাশি লড়াই করে আসা ভাড়াটে ওয়াগনার বাহিনী সম্প্রতি রুশ সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
তবে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় বিদ্রোহ থামাতে সম্মত হন ওয়াগনার প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিন।
এরপর রুশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির আওতায় ওয়াগনার বাহিনীর হাজার হাজার সদস্যকে বেলারুশে পাঠানো হয়।
সেখানে ওয়াগনার বাহিনী বেলারুশের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বলে আন্তর্তাজিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়।
তবে পোল্যান্ডের অভিযোগ, ওয়াগনার বাহিনী তাদের সীমান্তে তৎপরতা চালাচ্ছে।
সিএনএনের এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে,
সম্প্রতি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ওই এক চিলতে জমির নিকটেই ওয়াগনার বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে।
গত মাসের শেষ দিকে বিষয়টি নিয়ে প্রথম কথা বলেন পোলিশ প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকি।
তিনি বলেন, তার দেশের সীমান্তের দিকে এগোচ্ছে ওয়াগনারের শতাধিক যোদ্ধা।
এসব যোদ্ধারা অভিবাসী ছদ্মবেশে পোল্যান্ডে ঢুকতে পারে সন্দেহ করে উদ্বেগও প্রকাশ করেন তিনি।
চলতি সপ্তাহে পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়া সীমান্তে সামরিক মহড়া শুরু করে বেলারুশ।
এই মহড়ার বিষয়টি পোল্যান্ড কর্তৃপক্ষকেও অবহিত করে দেশটির সামরিক বাহিনী।
এর মধ্যেই পোল্যান্ডের অভিযোগ,
আরও বলা হয়,
‘খুবই কম উচ্চতায় ওড়ার কারণে রাডারে হেলিকপ্টারগুলোর উপস্থিতি ধরা পড়েনি।
এমন পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার (১ আগস্ট) পোল্যান্ড সীমান্তে বাড়তি সেনা ও সামরিক হেলিকপ্টার পাঠানোর ঘোষণা দেয় ওয়ারশ।
ন্যাটোকেও এই পদক্ষেপের কথা জানানো হয়।
বেলারুশ অবশ্য পোল্যান্ডের এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে ন্যাটোর সদস্য দেশ পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে পালটা অভিযোগ করে।
সীমান্তে সেনাসংখ্যা বাড়ানোর ‘অজুহাত’ হিসেবে এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলা হচ্ছে বলে এক বিবৃতিতে জানায় দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
ঘটনাটি সম্পর্কে পোল্যান্ডের সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে বারবার পরিবর্তনের প্রতি নজর আকর্ষণ করে বেলারুশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, অভিযোগের সপক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ পেশ করা হয় নি।
বিদেশি ‘মনিব’-দের সঙ্গে কথা বলেই পোল্যান্ড মতবদল করেছে।
পূর্ণ সংঘাতের ঝুঁকি
পোল্যান্ডের বক্তব্য অনুযায়ী,
বেলারুশের সামরিক হেলিকপ্টারের পোল্যান্ডের আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনাটি ঘটেছে সুয়ালকি করিডর অঞ্চলের কাছেই।
৬০ মাইল দীর্ঘ এক খণ্ড জমি কৌশলগতভাবে রাশিয়া ও বেলারুশের জন্য যেমন তাৎপর্যপূর্ণ।
একইভাবে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কাছেও গুরুত্বপূর্ণ।
সীমান্তবর্তী এলাকাটি রাশিয়ার কালিনিনগ্রাদকে বেলারুশের সঙ্গে যুক্ত করেছে এবং একই সঙ্গে এটি বাল্টিক দেশগুলো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাকি অংশের মধ্যে সংযুক্ত করে।
আর এ কারণেই ওই এলাকায় রাশিয়ার ওয়াগনার ভাড়াটে বাহিনীর তৎপরতা পোল্যান্ডের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে।
গত শনিবার পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকি বলেন,
বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো অবশ্য পোলিশ প্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্য উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, যে ওয়াগনার বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পোল্যান্ডের বরং কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
গত মাসে তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনার সময়ে বলেন, অনেকটা ঠাট্টাচ্ছলে বলেন, ‘কিছু ওয়াগনার যোদ্ধা সীমান্ত পেরিয়ে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ পর্যন্ত যেতে আগ্রহী।’
বেলারুশ যেভাবে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাতে রাশিয়াকে সাহায্য করে আসছে এবং নিজ দেশে রুশ পরমাণু অস্ত্র মোতায়েন করতে অনুমতি দিয়েছে, বিষয়টি পশ্চিমা বিশ্বকে বেশ উদ্বেগে ফেলেছে।
তার ওপর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন গত সপ্তাহে পোল্যান্ডকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘বেলারুশের ভূখণ্ড দখলের চেষ্টা করলে রাশিয়া সেই হামলাকে নিজের উপর হামলা হিসেবে বিবেচনা করবে।’
এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ইউক্রেন যুদ্ধের আঁচ সরাসরি ন্যাটোর উপর পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র আপাতত ঘটনাটিকে অন্তত প্রকাশ্যে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না।
মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা মুখপাত্র জন কিরবি বলেন,
বেলারুশে ভাগনার ভাড়াটে বাহিনীর উপস্থিতি পোল্যান্ড বা ন্যাটো সহযোগীদের জন্য স্পষ্ট হুমকির কারণ হতে পারে, এমন কোনো কারণ ওয়াশিংটন দেখছে না।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বেলারুশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ইউক্রেনে অভিযান শুরু করে রাশিয়া।
যা লুকাশেঙ্কা ও পুতিনের মধ্যকার সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন,
এখন সুয়ালকি করিডরে সেনা মোতায়েন রাশিয়া ও কালিনিনগ্রাদের মধ্যে একটি সরাসরি সংযোগ তৈরি করবে।
নর্দার্ন ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কেস্টার ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাষক বারবারা ইয়োক্সন বলেন,
‘পশ্চিমে ক্যালিনিনগ্রাদ ও পূর্বে বেলারুশ উভয় দিক থেকে সেনা মোতায়েন করার মাধ্যমে রাশিয়া কার্যকরভাবে মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপে তার ন্যাটো মিত্রদের থেকে বাল্টিক রাজ্যগুলোকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হবে৷
আর এটা পরিণামে পুতিনকে লিথুয়ানিয়া,
লাটভিয়া বা এস্তোনিয়ার মতো দেশে আক্রমণ করার সুযোগ করতে দিতে পারে।’
এই বিশ্লেষক আরও বলেন,
‘রাশিয়া যদি সুয়ালকি করিডরের কাছে সেনা মোতায়েন করে, তবে এটি অন্যান্য ন্যাটো দেশগুলোকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে।
এমনকি ন্যাটো এই অঞ্চলে তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উপর সরাসরি আক্রমণ হিসাবেও দেখতে পারে।
যা রাশিয়া ও ন্যাটোর চলমান দ্বন্দ্বকে একটা ‘পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে’র দিকে নিয়ে যেতে পারে।’