রাশিয়ার সঙ্গে চলমান যুদ্ধের মধ্যে অত্যাধুনিক অস্ত্রের পর এবার ইউক্রেনকে নিষিদ্ধ ক্লাস্টার বোমা বা গুচ্ছ বোমা সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে কিয়েভের চলমান পাল্টা অভিযান জোরদার করতে এ অস্ত্র দেয়া হচ্ছে।
এই বোমায় বহু বেসামরিক নাগরিক হত্যার রেকর্ড থাকায় এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে।
তবে কেন নিষিদ্ধ এ ক্লাস্টার বোমা ইউক্রেনে পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
ক্লাস্টার বোমা এমন এক ধরনের বোমা যার মধ্যে একাধিক বিস্ফোরক বা বোমা থাকে।
গুচ্ছ বোমার একটি ক্যানিস্টার ১০টি থেকে শুরু করে শত শত ছোট বোমা বহন করতে পারে।
ক্যানিস্টারগুলো বিমান, আর্টিলারি, নৌ বন্দুক অথবা রকেট লঞ্চার থেকে নিক্ষেপ করা যায়।
লক্ষ্যবস্তুর ওপর নির্ভর করে ক্যানিস্টারগুলো একটি নির্ধারিত উচ্চতায় এসে খুলে যায়।
এরপর ভেতরে থাকা বোমাগুলো নির্দিষ্ট এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
রাশিয়ার হুমকি উপেক্ষা করে অবশেষে ইউক্রেনকে বিতর্কিত এই ক্লাস্টার বোমা দিতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
গোলাবারুদের মজুত ফুরিয়ে যাওয়াসহ রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে লড়তে ইউক্রেন বাহিনীকে এই বোমা সরবরাহে ওয়াশিংটনের ঘোষণার পর, তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে বাইডেন প্রশাসন।
ওয়াশিংটনের এমন সিদ্ধান্তের ঘোর বিরোধিতা করেছে খোদ জাতিসংঘ।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই রাশিয়াকে প্রতিহত করতে একের পর এক সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব।
যুক্তরাষ্ট্রের আব্রামস ট্যাংক, জার্মানির লিওপার্ড টু ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের বোমা, যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি অত্যাধুনিক সব সমরাস্ত্র দেয়া হচ্ছে ইউক্রেনকে।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে হঠাৎ করেই ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষিদ্ধ ক্লাস্টার বোমা সরবরাহের ঘোষণায় দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
কেনই বা এই বোমা দেয়া হচ্ছে ইউক্রেনকে নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা।
মূলত নিষিদ্ধ গুচ্ছবোমা এই ক্লাস্টার দশ থেকে কয়েকশ ছোট বোমা বহন করতে সক্ষম।
নিক্ষেপের পরপরই ভেতরে থাকা বোমাগুলো নির্দিষ্ট এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
একইসঙ্গে ভূমির কাছাকাছি বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য বোমা বিস্ফোরণে টাইমারও ব্যবহার করা হয়।
ক্লাস্টার বোমাটি বিতর্কের আরও একটি কারণ এটি নিক্ষেপের পর একইসঙ্গে একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম।
এতে সৈন্যর পাশাপাশি মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হন বেসামরিক নাগরিকরা। এছাড়া বোমা নিক্ষেপের পর কখনো কখনো ১০ থেকে ৪০ শতাংশ অক্ষত অবস্থায় থেকে যায়।
যা নিক্ষেপের কয়েক দশক পরও বিস্ফোরিত হতে পারে। এতে, বহু মানুষের প্রাণহানির সম্ভাবনা থাকে।
মার্কিন সেনাবাহিনীর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ডিপিআইসিএমএস নামে পরিচিত ক্লাস্টার বোমার মজুত রয়েছে।
ওয়াশিংটন কিয়েভকে যেসব ক্লাস্টার সরবরাহ করছে তার প্রতিটি ক্যানিস্টারে ৮৮টি বোমা রয়েছে।
নিক্ষেপের উচ্চতার উপর নির্ভর করে বোমাটি এলাকার ৩০ হাজার বর্গমিটার পর্যন্ত ধ্বংস করতে পারে।
কনভেনশন অন ক্লাস্টার মিনিশনস মজুত, উৎপাদন এমনকি স্থানান্তরকেও নিষিদ্ধ করেছে।
সেই কনভেনশনে যোগ দিয়েছিল ১২৩টি দেশ। তবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন, রাশিয়াসহ বিশ্বের ৭১টি দেশ তাতে যোগ দেয়নি।
ক্লাস্টার অস্ত্রগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত তিন ডজনেরও বেশি সংঘর্ষে ব্যবহৃত হয়েছে।
২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে সর্বশেষ এই অস্ত্রগুলোর ব্যবহার করেছিল।
তবে ধারণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে রাশিয়ার কাছে সবচেয়ে বেশি ক্লাস্টার বোমার মজুত রয়েছে।
গণবিধ্বংসী হওয়ায় ২০০৮ সালে ‘কনভেনশন অন ক্লাস্টার মিউনিশন’ চুক্তির মাধ্যমে এই মারণাস্ত্র নিষিদ্ধ করা হয়।
এ সময় ক্লাস্টার বোমা নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ১০৭টি দেশ।
তবে এখন পর্যন্ত এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি বেশ কিছু দেশ। তার মধ্যে অন্যতম হল যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ইসরাইল, ভারত, পাকিস্তান ও ব্রাজিল।
মূলত এসব দেশের হাতেই বেশিরভাগ ক্লাস্টার বোমা রয়েছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই বোমা চেয়ে আসছে ইউক্রেন।
এক বছরেরও বেশি সময় পর ক্লাস্টার বোমার সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
কিয়েভকে এই বোমা দেয়ার ব্যাপারে হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘অবিস্ফোরিত বোমার কারণে সাধারণ মানুষের ক্ষতি হতে পারে’- এমন ভাবনা থেকে ইউক্রেনকে ক্লাস্টার বোমা সরবরাহের বিষয়টি দীর্ঘদিন আটকে রাখা হয়েছিল।
শুক্রবার (৭ জুলাই) হোয়াইট হাউসের এক ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেন, ইউক্রেনের পক্ষ থেকে বেসামরিক মানুষের সম্ভাব্য ক্ষতি কমিয়ে আনার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
এছাড়া যুদ্ধে রাশিয়াও ক্লাস্টার বোমা ব্যবহার করছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র কিয়েভকে এই অস্ত্র দিক বা না দিক, ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি গুরুত্ব পাবে।
জ্যাক সুলিভান আরও বলেন, অন্য দেশের ভূখণ্ডে এই অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইউক্রেন।
শুধু নিজেদের সীমানায় পাল্টা অভিযান চালাতে এটা ব্যবহার করবে ইউক্রেনীয় সেনারা।
এখন ইউক্রেনকে দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যেসব ক্লাস্টার বোমা মজুত আছে তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের।
ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের তুলনায় রাশিয়ার কাছে ক্লাস্টার বোমার মজুত বেশি রয়েছে।